MSKS: Manipuri Samaj Kalyan Samiti
বাংলাদেশে বসবাসকারী মণিপুরি সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী সমাজকল্যাণমূলক সংস্থা “মণিপুরী সমাজ কল্যাণ সমিতি” । স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে মণিপুরি সমাজের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতিই এ সংস্থার প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাসমূহের (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রন) অধ্যাদেশ ১৯৬১ ও স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাসমূহের (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রন) বিধি ১৯৬২ অনুযায়ী এ সংস্থাটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক নিবন্ধিত । সংস্থার নিবন্ধন নং মৌলভী ৩৮/৮৩ (৭৪)।
বর্তমানে সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলায় মণিপুরি বাস। এর মধ্যে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ০৮ টি গ্রামে তাদের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশী। এ গ্রামগুলো (তিলকপুর, মাধবপুর, বালিগাও, ঘোড়ামারা, ভানুবিল, তেতইগাও, কালারাইবিল ও গুলেরহাওড়) নিয়ে সংস্থার কেন্দ্রীয় অঞ্চল গঠিত এবং প্রধান কার্যালয় ঘোড়ামারা গ্রামে অবস্থিত।
সংস্থার কার্যক্রম সুচারু ভাবে পরিচালনা করার জন্য সংস্থাটির ০৯ শাখা রয়েছে। এ শাখাগুলোর বসবাসকারী সদস্যদের প্রয়োজন মোতাবেক সৃষ্টি করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি জেলা শাখা (মৌলভীবাজার, সিলেট, ঢাকা) পাঁচটি উপজেলা শাখা (শ্রীমঙ্গল, চুনারুঘাট, ছাতক, কোম্পানীগঞ্জ ও বড়লেখা) এবং ১ টি শহর শাখা (মাছিমপুর) রয়েছে। সংস্থার কেন্দ্রীয় ও শাখার সদস্যদের মধ্যে থেকে সংস্থার কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদ নির্বাচন করা হয়। শাখার কাজ পরিচালনার জন্য স্ব স্ব শাখার সদস্যদের মধ্যে থেকে শাখার কার্যকরী পরিষদ নির্বাচন করা হয়। কেন্দ্র ও শাখাগুলো একই গঠনতন্ত্র অনুসরণ করে এবং ঊভয়ের কার্যকরী পরিষদের মেয়াদ তিন বছর।
এ সংস্থাটি মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া, মৈতৈ ও মৈতৈ-পাঙ্গাল মণিপুরিদের উচ্চশিক্ষার ও সরকারী চাকুরীর পথ সুগম করতে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এ সংস্থার মাধ্যমে তৎকালীন (১৯৭৬ ইংরেজি) সভাপতি আধুনিক মণিপুরি সমাজের রূপকার স্বর্গিয় দীন নাথ সিংহের নেতৃত্বে মৈতৈ ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের প্রতিনিধি দলের সুনির্দিষ্ট ৫টি দাবী গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নিকট থেকে আদায় করা হয়। সংস্থার এসব সময়পোযোগী পদক্ষেপর জন্য এ সংস্থাটি মণিপুরিদের প্রাণপ্রিয় সংগঠনে পরিনত হয়েছে। বর্তমানে এর সাধারণ সদস্য সংখ্যা ২৫০০ জনের উপরে।
সামাজিক উন্নয়ন: মণিপুরি সমাজের মান সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, নিজেদের সামাজিক আচার-আচরণ ও সামাজিক কাঠামোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল করা। সমাজে নিজেদের মধ্যে এবং সমাজের বাইরে অন্যদের সাথে ভাল সম্পর্ক বজায় রাখতে সদস্যদের উৎসাহিত করা। সামাজিক উন্নয়নে নৈতিকতা বজায় রেখে সবাইকে সমাজিক ও রাজনৈতিক দলের উর্ধে থেকে একত্রিত হতে উদ্ভুদ্ধ করা এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীগুলির মধ্যে দ্বন্দ্ব কমানোর নতুন উপায় খুঁজে বের করা। মণিপুরি সম্প্রদায় সমূহের (বিষ্ণুপ্রিয়া, মৈতৈ ও মৈতৈ-পাঙ্গান) মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ।
সারা দেশে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে মণিপুরিদের জন্য সংরক্ষিত আসন নিশ্চিত করা।
মণিপুরী ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস ইত্যাদির উপর গবেষণা করতে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের সহায়তা প্রদান করা।
দরিদ্র কিন্তু মেধাবী মণিপুরি শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করা।
প্রতি মণিপুরি এলাকায় লাইব্রেরি স্থাপন করতে মানুষে সচেতন করা।
স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারী কর্মসূচির সাথে সহযোগিতা করা ।
দরিদ্র রোগীকে অর্থ সংগ্রহ করতে বা তাদের চিকিৎসা খরচ বহন করে রোগীদের সহায়তা প্রদান করা ।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিওর সাথে মিলে বিভিন্ন স্বাস্থ্য শিবিরের ব্যবস্থা করা ।
মণিপুরী এলাকায় খেলার মাঠের ব্যবস্থা করা এবং বিভিন্ন খেলাধুলা প্রতিযোগিতা পরিচালনা করা সহ খেলোয়াড়দের জাতীয় পর্যায়ে ক্রীড়া প্রতিযোগীতাতে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করা ।
ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ "মণিপুর" হচ্ছে বাংলাদেশে বসবাসকারী মণিপুরিদের আদি বাসস্থান। ২২,৩২৭ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট এ প্রদেশের দক্ষিণ পূর্ব অংশ মায়ানমারের সাথে ৩৫২ কি.মি. সীমানা নির্ধারণ করেছে। এ প্রদেশের উত্তরে নাগাল্যান্ড প্রদেশ, পশ্চিমে আসাম ও দক্ষিণে মিজোরাম প্রদেশ অবস্থিত। ভূ-প্রকৃতি অনুসারে মণিপুরকে পার্বত্য ও উপত্যকীয় এই দুটি অঞ্চলে ভাগ করা যায়। পার্বত্য অঞ্চল মাঝখানের উপত্যকীয় অঞ্চলকে বেষ্টন করে রেখেছে। প্রদেশের ৯০ ভাগ (২০,০৮৯ বর্গকিলোমিটার) অংশ পার্বত্য ভূমি বাকী ১০ ভাগ (২,২৩৮ বর্গকিলোমিটার) সমতল বা উপত্যকীয় অঞ্চল। উপত্যকার গড় উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ৭৫০ মিটার আর পার্বত্য অঞ্চলের গড় উচ্চতা অঞ্চল ভেদে ১,৫০০ মিটার থেকে ১,৮০০ মিটার। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ৬৫ ইঞ্চি।
পার্বত্য অঞ্চল ৫ টি জেলা নিয়ে গঠিত যথা- সেনাপতি, থামেনলং, চূড়াচাঁদপুর, চানদেল ও উখরুল আর উপত্যকীয় অঞ্চল পূর্ব ইম্ফল, পশ্চিম ইম্ফল, থৌবাল ও বিষ্ণুপুর এ চারটি জেলা নিয়ে গঠিত। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিরা বিষ্ণুপুর শহর ও তার আশে পাশে বাস করত।
মণিপুর শব্দ থেকে মণিপুরি নামের প্রসারতা ও ব্যাপকতা। বাংলাদেশে তিন প্রকারের মণিপুরি বাস করেন- বিষ্ণুপ্রিয়া, মৈতৈ ও মৈতৈ-পাঙাল। বিষ্ণুপ্রিয়ারা প্রধানত আর্যীয়, মৈতৈরা প্রধানত মঙ্গোলীয় বংশভূত এবং মৈতৈ-পাঙাল আর্য ও মঙ্গোলীয় উভয় ধারার মিশ্রণে উদ্ভুত। বিষ্ণুপ্রিয়ারা আদিকাল থেকে সনাতন ধর্মাবল্বী, বিষ্ণুভক্ত বৈষ্ণব, মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষায় কথা বলেন। মৈতৈরা প্রাচীন কালে তাদের লোকধর্ম পালন করতেন পরবর্তিতে তারা প্রথমে রামান্দি ও পরে গৌড়িয় বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হন। মৈতৈ-পাঙাল মণিপুরিরা ইসলাম ধর্মাবলম্বী। মৈতৈ ও মৈতৈ-পাঙালরা মণিপুরি মৈতৈ ভাষায় কথা বলেন।
মৈতৈরাজ পামহৈবার আমল (১৭১৪ -১৭৫৪) থেকে রাজপৃষ্ঠপোষকতায় মণিপুরে মৈতৈদের মাঝে হিন্দু ধর্মের প্রসার ঘটে। তখন সিলেটে হতে আগত হিন্দু ধর্মগুরু শান্তিদাস বাবাজীর মাধ্যমে মণিপুরে রামান্দি ধর্ম প্রচারিত হয়। রাজা পামহৈবা সহ অধিকাংশ প্রজা নিজেরদের শুদ্ধ করে রামান্দি ধর্ম দীক্ষিত হন। পরবর্তীতে রাজর্ষি ভাগ্যচন্দ্রের (রাজত্বকাল ১৭৬৪ থেকে ১৭৯৯) সময় গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের ব্যাপক প্রচার ঘটে। তাঁর রাজত্ব কালেই মণিপুরের প্রায় সবাই গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হন। তাঁর হাত ধরে সৃষ্টি হয় রাধাকৃষ্ণের লীলাভিত্তিক রাস, রাখোয়াল ও মণিপুরি নটপালা। কথিত আছে ভাগ্যচন্দ্র মহারাজ স্বপ্নদৃষ্ট হয়ে মণিপুরি মহারাসলীলার প্রবর্তন করেছিলেন। মহারাসলীলা মণিপুরিদের প্রধান ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসব।
রাজর্ষি ভাগ্যচন্দ্র সিংহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্রদের মধ্যে রাজ্যলিপ্সা ও ভ্রাতৃকলহ শুরু হয়। এর সুযোগ নিয়ে তৎকালীন বার্মার রাজা মণিপুর আক্রমন করে ১৮১৯ থেকে ১৮২৬ সাল পর্যন্ত দখল করে ধ্বংস ও নৃশংসতা চালায়। মণিপুরের ইতিহাসে এ সময়টিকে "৭ বছরব্যাপী ধংসযজ্ঞ" নামে পরিচিত। এ সময়ে মণিপুরিরা দল বেধে পাশের ভারতীয় প্রদেশ (আসাম ও ত্রিপুরা) এবং বাংলাদেশে প্রবেশ করেন ও স্থায়ী আবাস গড়ে তুলেন। জনশ্রুতি আছে যে, মণিপুরিরা নেত্রকোনার সুসাং দুর্গাপুর হয়ে প্রথমে বাংলাদেশ প্রবেশ করেন পরবর্তীতে তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পরে। কালের আবর্তে নেত্রকোনা, কুমিল্লা, ঢাকায় মণিপুরিদের বসতি বিলুপ্ত হয়। বর্তমানে সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলায় মণিপুরিরা বসবাস করছেন। এর মধ্যে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় মণিপুরিদের বাস সর্বাপ্রেক্ষা বেশী। বৃটিশ ভারতের অন্যান্য জাতির ন্যায় মণিপুরিরাও বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন সহ অন্যান্য স্বাধিকার আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৩০ সালের ভানুবিল কৃষক প্রজা আন্দোলন ছিল এর মধ্যে অন্যতম।
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত ব্রিটিশমুক্ত হয়ে ধর্ম ভিত্তিক দুটি স্বাধীন দেশ ভারত ও পাকিস্তানে পরিনত হয়। এর আগে গণভোটের ভিত্তিতে সিলেট জেলা বৃহত্তর পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়ে ওঠে। সে বিভাজন সিলেট জেলার মণিপুরিদের ভারতের মূলধারার মণিপুরি জনসংখ্যা থেকে আলাদা করে। এর অব্যবহিত পরে ১৯৫০ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয় ক্রমে ক্রমে তা ভারতীয় উপমহাদেশে অনেক স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত সংখ্যালঘু হিন্দুরা দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে শুরু করে একই সাথে ভারত থেকেও সংখ্যালঘু মুসলমানরা পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয় গ্রহন করেন। দাঙ্গার তীব্রতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় যা তা প্রশমনের জন্য ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিটি "নেহেরু-লিয়াকত" বা "দিল্লি চুক্তি" নামে পরিচিত ছিল। এই চুক্তি অনুযায়ী ভারত এবং পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশ, জেলা, মহকুমা, এবং থানায় সংখ্যালঘু বোর্ড গঠন করে উভয় দেশের সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়।
সনাতন ধর্মের বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অনুসারী হওয়ার কারণে, বাংলাদেশে মণিপুরিরাও দাঙ্গা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। অনেক মণিপুরিরা দেশত্যাগ করেছিলেন আবার অনেকে দেশত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তৎকালীন সিলেট জেলা প্রশাসনের অনুরোধে মণিপুরি সম্প্রদায়ের নেতারা (মৈতৈ ও বিষ্ণুপ্রিয়া) নিজেদের নিরাপত্তা সহ মণিপুরিদের দেশত্যাগ রোধ করার উদ্দেশ্যে একটি সামাজিক কল্যাণমূলক সংস্থা গঠন করার সিদ্ধান্ত নেন। সে সিদ্ধান্ত অনুসারে, ১৭ মে ১৯৫০ তারিখে, কমলগঞ্জ থানার (বর্তমানে কমলগঞ্জ উপজেলা) মৈতৈ গ্রাম হক্তিয়ারখলার রমন বিহারী শর্মার মন্ডপে মৈতৈ ও বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদায়ের বিশাল এক সভায় "পাকিস্তান ক্ষত্রিয় মণিপুরী শান্তি রক্ষা সমিতি" নামে একটি নতুন সামাজিক কল্যাণ সংস্থা গঠন করেন। পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। এ সংস্থাটি তার জন্মলগ্ন থেকেই খুব সক্রিয় ছিল। এটি সরকারের সাথে যোগাযোগসহ মণিপুরিদের অধিকার ও কল্যাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। এ সংস্থার মাধ্যমে ১৯৫১ সালে মণিপুরীদেরকে পৃথক ইউনিট হিসেবে আদমশুমারীতে গণনা করার আদমশুমারী কর্তৃপক্ষের প্রতি দাবী জানানো হয়েছিল ।১৯৫১ইং সালে বিষ্ণুপ্রিয়া অধ্যুষিত মাধবপুর গ্রামের জোড়ামন্ডপে দ্বিতীয় বার্ষিক সাধারণ সভায় তৎকালীন মৌলভীবাজার মহকুমার মহকুমা প্রশাসক প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে সংস্থাকে আরও কল্যাণমূলক করতে নেতাদের উৎসাহিত করেন।
১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সংস্থাটি সক্রিয়ভাবে জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য ও অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করে। এর প্রতিক্রিয়ায় অনেক মণিপুরি মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ইং সনের ২০ শে জানুয়ারী ঘোড়ামারা গ্রামের দক্ষিণ মন্ডপে অনুষ্ঠিত এক সাধারণ সভায় সংগঠনের নাম "পাকিস্তান ক্ষত্রিয় মণিপুরী শান্তি রক্ষী সমিতির" থেকে "সিলেট জেলা মণিপুরী সমাজ কল্যাণ সমিতি" পরিবর্তন করার প্রস্তাব সর্বসন্মতিতে অনুমোদিত হয় এবং সংস্থার কার্যালয় মাধবপুরস্থ জোড়ামন্ডপে স্থাপন করার সিন্ধান্ত গ্রহন করা হয়। গৃহীত সিন্ধান্ত অনুযায়ী সংস্থাটি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদপ্তরে স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণমূলক সংস্থা হিসেবে নিবন্ধিত করার আবেদন করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৪ সালের ২৪ শে আগস্ট গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদপ্তর, চট্রগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের অধীনে এ সংস্থাকে স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাসমূহের (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রন) অধ্যাদেশ ১৯৬১ ও স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাসমূহের (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রন) বিধি ১৯৬২ অনুযায়ী (নিবন্ধন নং সিল ৩৮/৭৪) নিবন্ধিত করে। এরপর থেকে সংস্থাটি একটি নিবন্ধিত সংস্থা হিসেবে কার্যক্রম পরিচালিত করছে। নিবন্ধিত হয়ার পর থেকেই এ সংস্থা সমগ্র মণিপুরি সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক উন্নয়ন কারার উদ্যোগ গ্রহণ করতে শুরু করে।
১৯৭৩ সালের ২১ জানুয়ারী তারিখে বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈ মণিপুরি সম্প্রদায়ের সদস্যদের দ্বারা গঠিত একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করেন এবং যুদ্ধকালীন সময়ে মণিপুরি আধ্যুষিত এলাকার বিভিন্ন স্থাপনা পুনর্নির্মাণের দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি জমা দেন। এর ফলশ্রুতিতে তৎকালীন সরকারের ত্রাণ ও পূনর্বাসন মন্ত্রী জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী কমলগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ক্ষতিগ্রস্থ মণিপুরি গ্রামসমূহ পরিদর্শন করেন এবং ক্ষতিগ্রস্থ মণ্ডপ ও ধর্মিয় প্রতিষ্ঠান পুননির্মাণ ও সংস্কারের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেন।
১৯৭৬ সালের ২০ শে মার্চ তারিখে বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈ মণিপুরি সম্প্রদায়ের ৯ সদস্যের একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধি দল সংস্থার তৎকালীন সভাপতি আধুনিক মণিপুরি সমাজের রূপকার স্বর্গিয় দীন নাথ সিংহ ও আইনজীবি সুরচন্দ্র সিংহের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী আবদুস সাত্তারের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং মণিপুরিদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের ৫টি নির্দিষ্ট দাবী সম্বলিত একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন।
প্রতিনিধি দলের সদস্যবৃন্দ
পঞ্চদাবী
উপরোক্ত দাবীসমূহের সবগুলোই সদাশয় সরকার কর্তক অনুমোদিত হয়। এর অব্যবহিত পরে রেডিও বাংলাদেশ, সিলেট কেন্দ্রে মণিপুরি অনুষ্ঠান প্রচারের আদেশ হল। কিন্তু মৈতৈ সম্প্রদায় শুধুমাত্র মৈতৈ ভাষায় অনুষ্ঠান পরিচালনা করার দাবী করলে দুই সম্প্রদায়রে মধ্যে বিবাদের সূত্রপাত হয় এবং অনুষ্ঠান প্রচার ৪ মাস পর্যন্ত স্থগিত থাকে। পরবর্তিতে রেডিও বাংলাদেশ ও টেলিভিশনের মহাপরিচালক জনাব এম এহিয়া খান মহোদয়ের উপস্থিতিতে রেডিও বাংলাদেশ, সিলেট কেন্দ্রের আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈ নেতৃবৃন্দের সর্বসন্মতিতে মৈতৈ ও বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষায় মণিপুরি অনুষ্ঠান পরিচালনা করার সিন্ধান্ত গৃহীত হয়। সে সময় থেকে আজ পর্যন্ত "মৃদঙ্গ" নামের এ অনুষ্ঠান সিলেট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হচ্ছে।
এর সাথে সাথে মণিপুরি শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত বেকার যুবকেরা সরকারের বিভিন্ন বাহিনীতে বিশেষ সুবিধা পেয়ে চাকুরীতে যোগদান করতে শুরু করল। ১৯৭৭ ইং সনের ১৯ শে এপ্রিল তৎকালীন মহামান্য রাস্ট্রপতির মহিলা বিষয়ক উপদেষ্টা ফিরোজা বেগম মাধবপুর গ্রামের শিববাজারে মণিপুরি ললিতকলা একাডেমী ও বয়নশিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলে মণিপুরি ললিতকলা একাডেমী ও বয়ন শিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এরি মধ্যে বাংলাদেশের মণিপুরিদের জন্য সরকারী মেডিকেল কলেজ ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বিশেষ কোটা সংরক্ষিত হল।
এরপর ২ মে ১৯৮২ ইং সনে ঘোড়ামারা গ্রামের দক্ষিণ মন্ডপে অনুষ্ঠিত সভায় সংস্থার কাজ আরও গতিশীল ও সবার সাথে যোগাযোগের সুবিধার্থে সংস্থার কেন্দ্রীয় কার্যালয় মাধবপুর জোড়ামন্ডপ থেকে মণিপুরি সমাজের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত গ্রাম ঘোড়ামারায় স্থানান্তর করা হয় এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে অনুমোদন নেয়া হয়। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা, ঘোড়ামারা গ্রামের অন্যতম পুরোহিত প্রয়াত নীলমণি চ্যাটার্জি ঘোড়ামারা গ্রামে ৪ শতাংশ ভূমি দান করে সংস্থার কার্যালয় নির্মাণের কাজে এগিয়ে আসেন। পরবর্তিতে সংস্থার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত পদ্মাসেন সিংহ ৮ শতাংশ ভূমি ও ঘোড়ামারা গ্রামের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সহায়তাকারী প্রয়াত পিতাম্বর সিংহ এক (১) শতক ভূমি দান করেন। অতপর ২০০১ ইং সনে তৎকালীন সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত পদ্মাসেন সিংহ সম্পূর্ন নিজ অর্থায়নে সংস্থার নিজস্ব ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেন।
১৯৮৩ ইং সনে মৌলভীবাজার মহকুমা জেলায় উন্নীত হলে ১৯৮৩ ইং সনের ৭ জুলাই একটি সভার সংস্থার নাম "সিলেট জেলা মণিপুরী সমাজ কল্যাণ সমিতি" পরিবর্তন করে "মণিপুরী সমাজ কল্যাণ সমিতি" নামকরণ করা হয় এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগ তা অনুমোদন করে এবং সমিতির নিবন্ধন সিল ৩৮/৭৪ থেকে পরিবর্তিত হয়ে মৌলভী ৩৮/৮৩(৭৪) পরিনত হয়। অত্র সমিতি বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে মনিপুরিদের প্রতিনিধিত্ব করে সদাশয় সরকারের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে আসছে। সমিতির গঠনতন্ত্র মোতাবেক নির্ধারিত মেয়াদের পর পর নতুন নতুন কার্যকরী পরিষদ গঠন করে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। ২০১০ থেকে ২০১১ ইং এ দু বছরে সমিতির শাখা সমূহ (সিলেট জেলা, মৌলভীবাজার জেলা, ঢাকা জেলা, ছাতক উপজেলা, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা, চুনারুঘাট উপজেলা, মাছিমপুর শাখা, শ্রীমঙ্গল উপজেলা) গঠিত হয়। কমলগঞ্জ উপজেলার ৮টি গ্রাম নিয়ে কেন্দ্রীয় অঞ্চল হিসেবেই পরিচিতি পায়।
শাখা সমূহ গঠিত হওয়ার পর সংস্থার কার্যক্রমে আরও নব উদ্যমে শুরু হয়। সংস্থার সদস্য সংখ্যা প্রায় ১০০০ জনে উন্নীত হয়। সংস্থার কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদ কেন্দ্রীয় অঞ্চল ও শাখা সমূহের সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন। ২০১১ইং সনের ৯ সেপ্টেম্বর ৪টি ভোট কেন্দ্রে এ ভোট অনুষ্ঠিত হয়। এ ভোটের মাধ্যমে বাংলাদেশের মনিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়ারা গনতন্ত্রায়নের পথে নুতন পদক্ষেপ দিয়েছিল।
সমিতির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাংলাদেশে মণিপুরি সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অন্যান্য উন্নয়ন সাধন করা ।